ধর্মীয়

মহানবী (সা.) যেভাবে রমজানের প্রস্তুতি নিতেন

রমজান হলো ইবাদতের বসন্তকাল। একজন মুমিনের আধ্যাত্মিক পরিচর্যা ও সওয়াব অর্জনের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার নৈকট্য এবং তাঁর দয়া-করুণার আধারে সিক্ত হওয়ার সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। যার জন্য অনেক প্রস্তুতি প্রয়োজন। কারণ সৈনিকদের যত বড় রণক্ষেত্র, তত বড় প্রস্তুতি।

নবী (সা.) রমজান আসার আগেই তিনি পুরোদস্তুর প্রস্তুতি গ্রহণ করতেন। নফল ও অন্য ইবাদত বাড়িয়ে দিতেন। রমজানের বরকত ও গুরুত্বের কথা বিভিন্ন সমাবেশে উল্লেখ করতেন এবং রোজা রাখার প্রতি খুবই গুরুত্ব দিতেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) রমজান এত ভালোবাসতেন যে প্রায়ই এর জন্য দোয়া করতেন।

সে জন্য তিনি শাবান মাস থেকেই রমজানের প্রস্তুতি গ্রহণ করতেন ও অধিক হারে রোজা রাখতেন। এমনকি তিনি রমজান মাস অত্যন্ত উত্সাহ ও ভালোবাসায় বরণ করে নিতেন।
নিম্নে রমজানকে স্বাগত জানানো ও প্রস্তুতি সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আমলের কিছু দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা হলো :

এক. মহানবী (সা.) এই বরকতময় মাসটিকে আহলান সাহলান বলে স্বাগত জানাতেন এবং সাহাবায়ে কিরামকে তিনবার এই প্রশ্ন করতেন : কে তোমাদের স্বাগত জানাচ্ছে এবং তোমরা কাকে স্বাগত জানাচ্ছ? উমর ইবনে খাত্তাব (রা.) বলেন, হে আল্লাহর রাসুল! কেউ কি ওহি নিয়ে আসছেন? তিনি বলেন, না। প্রশ্ন করা হলো, শত্রুর সঙ্গে কি যুদ্ধ হবে? মহানবী (সা.) বলেন, না।

পুনরায় জিজ্ঞেস করা হলো, তাহলে কী? রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাআলা রমজান মাসের প্রথম রাতে সব কিবলাবাসীকে ক্ষমা করে দেন। (আত-তারগিব ওয়া আত-তারহিব, হাদিস : ১৫০২)
দুই. আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রজবের চাঁদ উদিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাসুলুল্লাহ (সা.) আল্লাহর কাছে এই দোয়া করতেন—হে আল্লাহ! রজব, শাবান আর (বিশেষ করে) রমজান মাসকে আমাদের জন্য বরকতময় করে দিন। (হিলয়াতুল আউলিয়া, খণ্ড ৬, পৃষ্ঠা ২৬৯)

তিন. উসামা ইবনে জায়েদ (রা.) বর্ণনা করেন, আমি জিজ্ঞেস করলাম—হে আল্লাহর রাসুল (সা.)! আপনি শাবান মাসে যতটা রোজা রাখেন, অন্য কোনো মাসে আপনাকে রোজা রাখতে দেখিনি? নবী (সা.) বলেছেন, এটি এমন একটি মাস যা রজব ও রমজানের মাঝামাঝি আর লোকেরা একে অবহেলা করে ও উদাসীন থাকে। অথচ এই মাসে (পুরো বছরের) আমল আল্লাহ তাআলার সামনে পেশ করা হয়, তাই আমি চাই আমার আমল রোজা অবস্থায় উঠুক। (নাসায়ি, হাদিস : ২৩৫৭)

আরও পড়ুনঃ  পবিত্র কুরআন পোড়ানো নিষিদ্ধ করছে ডেনমার্ক

চার. উম্মুল মুমিনীন উম্মে সালামা (রা.) বর্ণনা করেন, তিনি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে টানা দুই মাস রোজা রাখতে দেখেননি।

কিন্তু রাসুলুল্লাহ (সা.) শাবান মাসে টানা রোজা রাখতেন, যাতে তিনি রমজান মাসে রোজা রাখতে পারেন। (নাসায়ি, হাদিস : ২১৭৫)

আল্লামা ইবনে রজব হাম্বলি (রহ.) বলেন, শাবান হলো রমজানের প্রস্তুতিমূলক মাস, সুতরাং এ মাসে একই আমল করা উচিত, যা রমজান মাসে প্রচুর পরিমাণে করা হয় অর্থাত্ রোজা এবং কোরআন তিলাওয়াত ও অন্যান্য ইবাদত। আর শাবান মাসে বেশি রোজা ও তিলাওয়াতের গুরুত্বারোপ এ জন্য যে যাতে রমজান মাসের বরকত গ্রহণের জন্য সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুতির জন্য রোজা ও কোরআন তিলাওয়াতে অভ্যস্ত হওয়া যায়। (লাতায়িফুল মাআরিফ, পৃষ্ঠা ২৫৮)

সাহাবায়ে কিরামের আমলের মাধ্যমে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। আনাস (রা.) শাবান মাসে সাহাবায়ে কিরামের আমল সম্পর্কে বলেন, শাবানের শুরুতেই মুসলমানরা কোরআন তিলাওয়াতের প্রতি খুবই আগ্রহী হয়ে উঠতেন এবং তাদের সম্পদের জাকাত দিতেন, যাতে দরিদ্ররা রোজা রাখতে পারে এবং রমজান মাস যেন তারা আরো ভালোভাবে কাটাতে পারে। (লাতায়িফুল মাআরিফ, পৃষ্ঠা ২৫৮)

আমাদের করণীয়

তাই রমজানের আগে এভাবে রমজানের প্রস্তুতি নিতে হবে, যাতে রমজানের বরকত ও রহমত পরিপূর্ণভাবে লাভ করা যায়। নিম্নে কিছু বিষয় উল্লেখ করা হলো যার প্রতি আমাদের মনোযোগ দেওয়া উচিত—

এক. খাঁটি তাওবা করা। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যখন আমার হূদয় মেঘে ঢেকে যায়, আমি তখন আল্লাহর কাছে দিনে ১০০ বার ক্ষমা প্রার্থনা করি। (মুসলিম, হাদিস : ২৭০২)

অতএব, হৃদয় ও মনকে পাপ-পঙ্কিলতা থেকে পরিষ্কার করতে হবে। যাতে আমরা যখন রমজানে প্রবেশ করব, তখন যেন আমাদের জীবনের পাণ্ডুলিপি একটি নতুন অধ্যায় নিয়ে শুরু হয়, যার পৃষ্ঠাগুলো সম্পূর্ণ সাদা এবং স্বচ্ছ-পরিষ্কার থাকে।

দুই. মানুষের হক ও অধিকার আদায়ে সচেষ্ট হওয়া। অন্যের প্রতি জুলুম ও দুর্ব্যবহার এবং তাদের হক ও অধিকার থেকে বঞ্চিত করা এমন একটি বিষয়, যা একজন ব্যক্তিকে নেকি ও কল্যাণ থেকে বঞ্চিত করে। তাই রমজানের আগেই এ ধরনের সব বিষয়ের প্রতি খেয়াল, চিন্তাভাবনা করা এবং সেগুলো পরিহার করা বাঞ্ছনীয়।

আরও পড়ুনঃ  ঢাবিতে কোরআন পাঠের ঘটনায় আরবি বিভাগের চেয়ারম্যানকে শোকজ

তিন. নেক আমলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী কাজ পরিহার করা। একটু ভাবুন, কী কী জিনিস যা নেক আমল ও ইবাদতের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। যেমন : অপ্রয়োজনীয় গল্পগুজব, আড্ডা, মোবাইল ফোন, টিভি, অনিয়মিত সময়সূচি, অলসতা ও অবহেলা ইত্যাদি। এই সব অভ্যাস এখন থেকেই পরিহার করতে হবে। তবে এমন যেন না হয় যে রমজান এলো এবং চলেও গেল অথচ আমরা গাফলতের চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়েই রইলাম। জেগে উঠুন ও উদ্যমী হোন।

চার. আমলের প্রতি উদ্যমী হওয়া। রমজানের মাসআলা-মাসায়েল জেনে তদনুযায়ী আমল করার প্রতি উদ্যমী হওয়া।

পাঁচ. রমজানের জন্য চারপাশের পরিবেশ প্রস্তুত করা। বাসাবাড়ি, অফিস, বাজার-ঘাট, স্কুল, কলেজ, দোকানপাট, হোটেল, রেস্টুরেন্টে ও রেস্তোরাঁ ইত্যাদির পরিবেশ এমনভাবে তৈরি করতে হবে, যাতে দিনের বেলায় রোজার ব্যাঘাত না হয় এবং রাতে নামাজ ও তারাবিতে সমস্যা না হয়। সেই সঙ্গে কোরআন তিলাওয়াত, কিয়াম, জিকির, তাওবা-ইস্তিগফার, দান-সদকা, সদাচরণ ও আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার গুরুত্ব দেওয়া।

আল্লাহ তাআলা আমাদের রমজানের পূর্ণ প্রস্তুতি নিতে এবং সব ধরনের গুনাহ থেকে বিরত থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *