মতামত

নতুন রাজনৈতিক দলের উত্থান: সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন মোড় নিতে যাচ্ছে। জুলাই বিপ্লবের নেতৃত্বে একদল ছাত্রনেতা একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের প্রক্রিয়া এগিয়ে নিচ্ছে। রাজনৈতিক অঙ্গনে এটি স্বাভাবিক ঘটনা হলেও, এই দলটি গঠিত হচ্ছে এমন এক সময়, যখন দেশের রাজনীতি তীব্র অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই দলের আত্মপ্রকাশ কী রাজনৈতিক ভারসাম্যে পরিবর্তন আনতে পারবে, নাকি এটি শুধুই আরেকটি ক্ষণস্থায়ী উদ্যোগ হয়ে থাকবে—এটি এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে।

জুলাই বিপ্লব ছিল মূলত ছাত্র-জনতার নেতৃত্বে গঠিত একটি গণআন্দোলন, যা দেশে রাজনৈতিক পরিবর্তনের সূচনা করেছিল। এখন সেই আন্দোলনের নেতারাই সরকারে থাকা অবস্থায় নতুন রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম তৈরির চেষ্টা করছেন। তাদের দাবি, তারা জনগণের স্বার্থ রক্ষার জন্য একটি বিকল্প শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে চান। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সরকারে থেকে পাওয়া সুবিধা উপভোগ করার পর তারা কি আদৌ সত্যিকারের জনবান্ধব একটি দল গঠন করতে পারবেন? নাকি এটি কেবল ক্ষমতার অন্য রূপ মাত্র?

নতুন দলটির মূল নেতৃত্বে থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম এবং যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ, যারা শিগগিরই পদত্যাগ করবেন বলে জানা গেছে। এছাড়া, জুনে আরেক উপদেষ্টা মাহফুজ আলমও সরকারের দায়িত্ব ছাড়তে পারেন। এটি যদি সত্যি হয়, তবে এটি একটি বড় রাজনৈতিক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়।

নতুন দলের সম্ভাব্য গঠনের খবর ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে, বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে এ নিয়ে বিতর্ক দেখা যাচ্ছে। বিএনপি অভিযোগ করছে, সরকার সমর্থিত একটি অংশ রাষ্ট্রীয় সুবিধা ভোগ করে নতুন দল গঠনের মাধ্যমে রাজনৈতিক মঞ্চ প্রস্তুত করছে। অন্যদিকে, অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তারা এই উদ্যোগকে কোনো ধরনের সমর্থন দিচ্ছে না, বরং সরকারে থাকা কেউ যদি রাজনৈতিক দলে যুক্ত হতে চায়, তবে তাদের অবশ্যই পদত্যাগ করতে হবে।

আরও পড়ুনঃ  বিএনপির গণমিছিল ঘিরে ঢাকায় রাজনৈতিক উত্তেজনা

অন্যদিকে, নতুন দলটি যদি সত্যিই স্বাধীনভাবে আত্মপ্রকাশ করে এবং জনগণের স্বার্থ রক্ষার প্রতিশ্রুতি দেয়, তাহলে এটি দেশে একটি নতুন রাজনৈতিক বিকল্প সৃষ্টি করতে পারে। কারণ, দীর্ঘদিন ধরে দেশের রাজনীতি দুটি প্রধান দলের—আওয়ামী লীগ ও বিএনপির—মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে। জনগণ একটি তৃতীয় শক্তির প্রত্যাশা করলেও, এখন পর্যন্ত কোনো বিকল্প দল শক্ত অবস্থান নিতে পারেনি।

একটি রাজনৈতিক দল গঠন করা সহজ নয়, বিশেষ করে এমন একটি সময়ে যখন দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা চরমে। নতুন দলটি যদি শুধু তরুণদের আকৃষ্ট করতে চায়, তবে তাদের স্থায়ী জনসমর্থন পাওয়া কঠিন হতে পারে। বরং, তাদের এমন একটি দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে হবে যা বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে।

এছাড়া, এই দলের আদর্শ কী হবে, সেটিও গুরুত্বপূর্ণ। দলটির গঠনতন্ত্র নিয়ে আলোচনা চলছে, যেখানে তুরস্কের একে পার্টি, পাকিস্তানের তেহরিক-ই-ইনসাফ এবং ইন্দোনেশিয়ার আন্না হাদা পার্টির গঠনতন্ত্র বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। এটি একটি ভালো দিক যে, তারা বিভিন্ন দেশের উদাহরণ পর্যালোচনা করছে, তবে বাংলাদেশের বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন।

নতুন দলটি যদি মধ্যপন্থী হয় এবং গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নেতৃত্ব নির্ধারণ করে, তাহলে এটি একটি ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে। তবে, দলীয় কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে যদি স্বজনপ্রীতি বা দলীয় প্রধানের একক নিয়ন্ত্রণ দেখা যায়, তবে এটি টিকবে না।

নতুন রাজনৈতিক দল গঠন নিয়ে জনসাধারণের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। একদল মানুষ মনে করছেন, এটি সত্যিকারের রাজনৈতিক বিকল্প হতে পারে, অন্যরা বলছেন, এটি ক্ষমতার পুনর্বন্টনের একটি প্রচেষ্টা মাত্র।

নতুন দলটি ইতিমধ্যেই শতাধিক থানায় সংগঠন তৈরি করেছে এবং লংমার্চের মতো কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। তবে, রাজনৈতিক দল গঠনের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র কর্মসূচি যথেষ্ট নয়; জনগণের বিশ্বাস অর্জন করাটাই আসল চ্যালেঞ্জ। যদি তারা জনগণের জন্য বাস্তবসম্মত নীতি নির্ধারণ করতে পারে এবং দুর্নীতিমুক্ত রাজনীতি নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়, তবে তারা ভবিষ্যতে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হতে পারে।

আরও পড়ুনঃ  সাংবাদিক কাজল ‘গুম’ হওয়ার ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করলেন

আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে দল ঘোষণার পর এই নতুন রাজনৈতিক উদ্যোগ কতটা কার্যকর হবে, তা স্পষ্ট হয়ে উঠবে। তবে একটি বিষয় নিশ্চিত—দেশের রাজনীতিতে নতুন একটি শক্তি আসছে, এবং এটি বিদ্যমান দলগুলোর জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে। সময়ই বলে দেবে, এই উদ্যোগ কতটা সফল হবে।

বিশ্লেষক/মোহাম্মাদ – নুরে আলম

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button