প্রচ্ছদ

“একটি ভয়ংকর রাতের গল্প “

বুধবার রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর টিভির সামনে বসেছি, তখন আম্মু এসে আমার পাশে বসল। আমি আম্মুকে বললাম, “কী, কিছু বলবেন?” “হ্যা, তোর আনোয়ার মামার কথা মনে আছে?” আনোয়ার মামা একজন ব্যাংকার। তিনি দূর সম্পর্কের মামা। সাধারণত ব্যাংকের কাজ ছাড়া অন্য কখনো তার সাথে দেখা হয় না, আমি বললাম, “হ্যাঁ। ” “শুক্রবারে তো তার বিয়ে, আমাদের দাওয়াত, তাই কালকে বিকালে যাব। ” “আমি যাব না, আপনি ফারহান কে নিয়ে চলে যান।” “তোকে তো নিতেই হবে। নাহলে তো তোর বাবা রাগ করবে ” এবার আমার মনে হলো মাকে বলে আর কিছুই হবে না, আমার প্রবাসী বাবা আমাকে আর আমার ছোট ভাই ফারহানকে নিয়ে সবসময়ই চিন্তা করে। এই চিন্তার মাত্রা অনেক ভয়াবহ, তাই আমি আর মাকে কিছু বলার প্রয়োজন বোধ করিনি, আমি বাবাকে ফোন করার জন্য উঠে গেলাম। বাবাকে রাত ১১ টায় ফোন করলাম: “হ্যালো, বাবা, আসসালামুআলাইকুম” “ওয়ালাইকুম আসসালাম, কি অবস্থা, এতো রাতে ফোন করলে, কিছু কি বলবে?”

“হ্যা বাবা , আমি আসলে গ্রামে যেতে চাচ্ছি না, সেটাই বলতে ফোন দিয়েছি।” “কেন? তাছাড়া তুমি একা থাকবে কিভাবে?” “একমাস পর আমার পরীক্ষা,এখন আর সময় নস্ট করব। ” “তাহলে একা থাকবে কিভাবে? ” “বাবা, আমি তো আর এখনো ছোট নই। আমি ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পাড়ি। তুমি চিন্তা করো না ” এভাবে আরো বেশ কিছুক্ষণ বোঝানোর পর বাবা মানলেন। আমি চাইলে বেড়াতে যেতে পারতাম। পরীক্ষা কোনো বাধা নয়। পরীক্ষাও শুরু হবে আরো প্রায় দুই মাস পর। কিন্তু না যাওয়ার কারণ হচ্ছে ” টিম পার্টি “। আমার সব বন্ধুদের একটা দীর্ঘ দিনের ইচ্ছা রাতভর একটা পার্টি করবে। পার্টির নামও তারা ঠিক করে রেখেছিল বহু আগেই। কিন্তু পার্টি করা আর হয় নি, তাই এই সুযোগে পার্টিটা সেরে ফেলব, তাছাড়াও আমি কোনো অনুষ্ঠানে যাই না। ২. আমি ক্লাসে গিয়ে পার্টির কথা বলতেই পুরো ক্লাসের সব বন্ধুর মধ্যে একটা হইচই ভাব চলে এলো।

সকলেই সম্মতি জানাল। কিন্তু আমি জানি অল্প কিছুক্ষণ পরেই এই সংখ্যাটা কমে যাবে। কারণ এটাই বন্ধু সমাজের পার্টি কিংবা ট্যুরের নিয়ম। শুরুতে যদি আগ্রহী বন্ধুর সংখ্যা ১০০ জনও হয়, পরে সেই সংখ্যা কিন্তু ১০ বা ১২ তে গিয়ে অবস্থান করবে। ক্লাস শেষে আলোচনা করে পরে ঠিক হলো, পাঁচজন আসবে। সব টাকা খরচ করবে নাফিজ। রান্না করবে শুভ। আর বাকিরা টুকটাক কাজ করে করবে, আর সবচেয়ে বড়ো ব্যাপার যেটা, সেটা হলো বিনোদন, বিনোদন ছাড়া পার্টি যেন লবন ছাড়া গোশত, এই রকমই কিছু একটা হবে। সেই বিনোদনের জন্য যা যা দরকার সব কিছুর ব্যবস্থাই করবে রিয়াদ আর মুহিব। এদের কাছে আমার জানা মত গিটার, ঢোল, ল্যাপটপ ইত্যাদি আছে, আর গান গাওয়ার জন্য আমি তো আছিই “সিংগার পারভেজ “, আমার মতে আমিই এই দেশের সেরা গায়ক, যদিও বন্ধুরা কোনোদিনও দাম দেয় না। ৩. আম্মু চলে গেছে বিকাল চারটায়, যাওয়ার আগে আধ-ঘন্টা উপদেশ দিলেন। সব উপদেশই এই জীবনে বহুবার শুনেছি। প্রতিবারের মত এবারেও সবই মনোযোগ দিয়ে শুনেছি। আম্মু চলে যেতেই আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। আমার বন্ধুদের আসার কথা সন্ধা ছ’টায়। এ দুই ঘণ্টা নষ্ট না করে আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। সাড়ে ছ’টার একটু পরে যখন ঘুম থেকে উঠলাম, তখন আমি তো পুরাই অবাক। আমার বন্ধুরা দরজা ভাঙ্গার জন্য লোক জোগাড় করে ফেলেছে। এখন শুধু ভাঙ্গা বাকি, এই রকম অবস্থা।

আমার বাড়ি নোয়াখালীর চাটখিল উপজেলায়। আমাদের বাড়ির আশেপাশে চল্লিশ গজের ভিতর কোনো বাড়ি নেই। চারদিকে আছে শুধু মাঠ, যা বর্ষাকালে জলাশয়ের রুপ নেয়। অর্থাৎ, জায়গাটা এতোটাই নির্জন যে, আমাকে কোনো মানুষ বা ডাকাতের দল মেরে ফেললেও কেউ বাধা দেওয়ার মতো থাকবে না। এ কারণেই আমার বন্ধুরা এতো ভয় পেয়েছিল। তাদের ভয় ছিল যৌক্তিক। বাহিরে ততক্ষণে ১০-১২ জন লোক জমে গেছে। তাদেরকে বিদায় করতে বেশ কিছুটা সময় লাগলো। সবশেষ ফজলু কাকা বললেন, “রাইতে একা থাকতে ভয় লাগবো, রাইতে আমার বাড়িত আইয়ো।” “কাকা লাগবো না, আপনি চিন্তা কইরেন না।’ কাকা হয়তোবা কিছুটা অপমানিত বোধ করলেন। কিন্তু তাতে আমার কী? ৪. সন্ধ্যা সাতটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত রান্নার কাজ হলো, আমি জানতাম যে ভালো রান্না পারে শুভ কিন্তু এখন দেখলাম নাহিদ ও অনেক ভালো রান্না পারে। পৃথিবীতে একেক জনের একেক ধরণের প্রতিভা, রিয়াদ এর প্রতিভা লেখা-লেখি করা। শুভ আর নাহিদ রান্না ভালো পারে। মুহিব একটা বিনোদন বাক্স , দেশি- বিদেশি, অশ্লীল- সুশ্লীল সব ধরনের বিনোদনই তার বাক্সে থাকে , আমি গান ভালো পারি। আর কোনো ধরণের প্রতিভা হীন ব্যাক্তি নাফিস, যদিও কথাটা শতভাগ সত্য বলা যায় না। কারণ পড়া লেখায় সে একটা তাজি ঘোড়া, পড়া লেখায় সে তুলনাহীন। যাইহোক বিরিয়ানির মতো কিছু একটা বানিয়ে সবাই হাপিয়ে উঠলাম। জিনিসটার স্বাদ শতভাগ বিরিয়ানির মতা, কিন্তু দেখতে সুন্দর হয়নি একটুও। কেন তাও রাধুনিরা বলতে পারছে না। “স্বাদ টা ঠিক আছে, কিন্তু দেখতে অন্যরকম হয়ে গেছে, কিছু মনে করিছ না।” নাহিদ বলল। “দেখতে যেমনই হোক, সবাই খেয়ে ফেলব, যদি কারো সমস্যা হয়, তবে চোখ বন্ধ করে খেয়ে নিবে।” এই কঠিন কথাগুলো শুনেও কারো মন খারাপ হলো না। কারণ কথাটা মুহিব তার নিজস্ব ভঙ্গিতে বলেছে, মানে মজাদার ভঙ্গি। সবাই হেসে দিল। এর মধ্যে লেখক সাহেব আরেকটা প্রস্তাব করে বসল, রিয়াদ বলল, “চল, রাতের বাকি অংশটা ছাদে কাটাই, খাওয়া-দাওয়া, গান-বাজনা, মুভি দেখা সব সেখানেই করব, আজকে কিন্তু পুর্ণিমার রাত।” আজকে কীসের রাত যে সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা নেই। কিন্তু এ কথার সমর্থন একে একে প্রায় সবাই করল। মুহিব বলল, “হ্যা পারবেজ।

আরও পড়ুনঃ  স্ট্রবেরি চাষে ভাগ্য বদলের স্বপ্ন

কথাটা কিন্তু ঠিকই, চল ছাদে যাই। ” “রাতে ছাদেই ঘুমাব, আয় ছাদেই আয়।” নাফিস বলল। এভাবে বাকি সবাই সমর্থন দিল। ছাদে এক রুম পরিষ্কার করা ছিল, বড় একটা খাট ও আছে। পুরো ছাদটাও পরিস্কার, তাই আমার কোনো আপত্তি ছিল না। পুরো ঘরের সব দরজা জানালা বন্ধ করে আমরা সবাই ছাদে চলে গেলাম। ছাদে গিয়ে আগে খাওয়া দাওয়া করলাম। তারপর সবাই মিলে গলা ছেড়ে গান গাইলাম। সময় কেটে গেল খুব তাড়াতাড়ি। রাত তখন প্রায় সাড়ে বারোটা বাজে। এতো সময় পার হওয়ার আমি খেয়াল করলাম যে ছাদে কিন্তু আলো বেশি নেই। মানে এইটা হয়তোবা পুর্নিমার রাত নয়। তবুও আমি তেমন গুরুত্ব দিলাম না। কারন আমরা এখানে পার্টি করতে এসেছি, চাঁদ দেখতে নয়। আমাদের ছাদের একেবারে কাছেই আছে তিন-চারটা নারকেল গাছ। ছাদে রেলিং না থাকায় গাছগুলোতে সরাসরি উঠে যাওয়া যায়। গান গাওয়া শেষে সবাই সেই নারকেল গাছ গুলোর দিকে গেলাম। যেতে যেতেই নাফিস বলল, “ওই দেখ গাছে কে?” আমরা সবাই সেই দিকে তাকালাম। কিন্তু কিছুই দেখলাম না। শুভ বলল, “এইটা কী?” কথাটা বলেই সে অন্য একটা নারকেল আছেন দিকে এগিয়ে গেল। আমরা সবাই আবারও সেদিকে তাকালাম। কিন্তু এবারেও কিছু দেখলাম না। ঠিক তখনি আমি তিন নম্বর নারকেল গাছে একটা লোককে দেখতে পেলাম, দেখতে অনেক চিকন। অন্য কিছু খেয়াল করার আগেই লোকটা অদৃশ্য হয়ে গেল। এতোটাই দ্রুত যে, আমি কাউকে তা বলার সূযোগ পর্যন্ত পেলাম না, তখনই শুভ ঘোষণা করল, “বাড়িতে চোর ঢুকছে লাঠি লাগবো।” আমরা সবাই পুরো ছাদে খুজে তিনটা রড, দুইটা লাঠি পেয়েছি। আমার পাঁচ বন্ধু পাঁচটা অস্ত্র হাতে নিয়ে নিয়েছে। আমি কিছু পাইনি। তবে আমরা কেউই তখন এটা চিন্তা করিনি, চোর হলেও সে এক সেকেন্ডের ভেতর গায়েব হয়ে যায় কী করে? তাও আবার নারকেল গাছ থেকে? কারণ আমাদের ভেতর তখন এক কিশোর বয়সের এক উত্তেজনা কাজ করছে। যার সামনে এসব বাচ – বিচারে সময় নাই। যাইহোক, লাঠি হাতে তখন আমরা পুরো ছাদ ঘুরে ঘুরে দেখছি। তখনই দেখলাম, আমাদের বাগানের এক কোণে আগুন লেগে গেছে। আর সেই আগুনের মধ্যে কোনো একটা প্রাণী লাফাচ্ছে। আগুন ধীরে ধীরে বেড়ে চলছে।

আরও পড়ুনঃ  তরুণদের প্রত্যাশায় ২০২৪

“আগুন, আগুন। সবাই জলদি নিচে আয় ” কথাটা বলেই আমি সবার আগে নিচে গেলাম। তালা খুলে বের হয়ে পানির ব্যবস্থার জন্য একটা বালতি নিলাম, ট্যাপ থেকে পানি নিলাম। নাহিদ আমার হাত থেকে বালতিটা নিয়ে আগুনে পানি মারার জন্য যায়। অন্য দিক থেকে রিয়াদ চেচিয়ে বলে, “কীরে আগুন তো দেখতেছিনা।” আমরা সবাই অবাক হয়ে দেখলাম, আগুন গেল কই? চারদিক তো শান্ত। আমরা সবাই ধীরে ধীরে সেই দিকে এগিয়ে গেলাম, আসলেই সেখানে আগুন তো দূরের কথা, আগুনের তাপও নেই। নাফিস পেছন থেকে চিৎকার করে বলল, “ও দিকে দেখ? ” তার আঙ্গুল ছাদের দিকে। আমরা সকলেই বাগানে দাড়িয়ে ছাদের দিকে তাকালাম। ছাদের জিনিসটা দেখেই শুভ জ্ঞান হারাল। জিনিসটার আকৃতি গরুর মত, তবে সে কোনো গরু নয়, একটা কুকুর। এতো বড় কুকুর হয় যে সেটা কখনো আমাদের জানা ছিল না। আর কুকুরটার পেটের মাঝখানে দু’টা রড একদিক দিয়ে ঢুকে অন্য দিক দিয়ে বের হয়ে গিয়েছে। মাথা দিয়ে ক্রমাগত রক্ত পড়ছে। হয়ত আরো কোনো ভয়ংকর কিছুও ছিল, যা আমরা দেখতে পাইনি। কারণ, আলো ছিল খুবই কম। সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার ছিল চোখ। চোখের মণি এতটাই উজ্জ্বল ছিল যে তা বর্ণনাতীত। আর সেই চোখ দিয়ে কুকুরটা আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। এখান থেকে বিশ ফিট এগিয়ে গেলে আমরা ঘরে ঢুকে যেতে পারি। কিন্তু কেউ একটা একটা পা ফেলার সাহসও করতে পার ছিলাম না। তার উপর শুভ আমাদের পায়ের কাছে পড়েছিল। ততক্ষণে চারদিক থেকে অনেক ভয়ংকর আওয়াজ আসা শুরু করে। কাউকে -অনেক নির্যাতন করলে যেরুপ চিৎকার দিবে , অনেকটা সেই রকম চিৎকার। চারদিকে ভয়ংকর শব্দ, তার ভিতর আমরা ছয়জন তখনও দাঁড়িয়ে আছি। তবে এর মাঝে মুহিব শুভকে জাগানোর জন্য বার কয়েক চেষ্টা করল। আর আমি পাথরের মত নির্জিব হয়ে ছিলাম। এর মাঝে শুভর জ্ঞান ফিরে এলো। ততক্ষণাৎ সে কোনো দিকে না তাকিয়ে খোলা দরজার দিকে দৌড় দিল, আর ভিতরে ঢুকে গেল। তার দেখাদেখি আমরা সকলে একদৌড়ে ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে বসে পড়লাম। ঘরে ঢুকে কেউ খাটে, কেউ সোফায় বসে পড়ল। শুভ গিয়ে খাটে শুয়ে পড়ল। অল্প কিছুক্ষণের ভেতর ঘটে যাওয়া এই কাহিনীর ঘোর তখনো কাটেনি কারোই। তারমধ্যে আবার স্টিলের দরজায় একের পর এক বাড়ি পড়তে শুরু করেছে । আর প্রচন্ড শব্দ হচ্ছে। আমার মনে নেই এভাবে আমরা কতক্ষণ বসে ছিলাম। তবে দীর্ঘ একটা সময় পর এই শব্দ, দরজায় বাড়ি পড়া সব বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তাও আমরা স্বাভাবিক হতে পারছিলাম না। এক সময় শুভ ঘড়ি দেখে বলল, ” ফজরের সময় হয়ছে, আর কোনো সমস্যা হবে না।” আমি বললাম, ‘চল, নামায পড়ি। ” আমার কথার জবাব কেউ দিল না। যদিও কথাটা বলে আমি নিজেই লজ্জায় পড়ে গেলাম।কারণ আম্মু যাওয়ার পর বন্ধুদের সাথে মজায় মজায় তিন ওয়াক্ত নামাজ আদায় করিনি। হয়ত এই বিপদ না হলে আরও কয়েক ওয়াক্ত নামাজ মিস হতো। আসলে আমরা মানুষরা এখন কেন যেন এমন হয়ে যাচ্ছি। বিপদ আসলে আল্লাহ কে ডাকি, বিপদ গেলে আবার আল্লাহ কে ভুলে যাই। যদিও এইবার ইনশা আল্লাহ আর ভুলব না। তারপর সবাই একে একে সবাই নামায পড়ার প্রস্তুতি নিল। আমরা ফজরের নামাযের মাধ্যমে সেই ভয়ংকর, কলুষিত এবং রক্ত হিম করা রাতকে বিদায় জানালাম। সেবার আম্মু এসেছিল তিনদিন পর। তখন সারাদিন এদিক সেদিক ঘুরতাম। সন্ধ্যার পর কোনো বন্ধুর বাড়িতে চলে যেতাম। তারপর আবার সব ঠিকঠাক হয়ে গেল। লেখক:মো. আল আমিন ছাত্র তামিরুল মিল্লাত কামিল মাদ্রাসা, টংগী, গাজীপুর।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button