বাংলাদেশ

‘ওরে ডাক্তার বানাইতে যে কী কষ্ট করেছি, আর ও হইল জঙ্গি’, থামছে না বাবার কান্না

সিরাজগঞ্জের কৃষক আব্দুল হান্নানের একমাত্র ছেলে যেদিন রাজশাহী মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পেলেন সেদিন থেকেই গ্রামের লোকেরা তাকে ‘ডাক্তারের বাপ’ ডাকা শুরু করেছিলেন। যার চিকিৎসক হওয়া নিয়ে আশায় ছিলেন বাবা সেই ছেলে ‘জঙ্গিবাদে’ জড়িয়ে তার স্বপ্ন ভেঙে দিয়েছে; আফসোসের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ছেলে ডা. সোহেল তানজিম রানা পুরোপুরি চিকিৎসক হয়ে ওঠার বছরখানেক আগেই তার উগ্রবাদে জড়িয়ে পড়ার খবর পেয়েছিলেন বাবা। তখন থেকেই ছিলেন শঙ্কিত। ছেলের গতিবিধি দেখে নজরও রাখতেন, খারাপ পথে গেলে ‘হাত ভেঙে’ দেওয়ার হুঁশিয়ারিও দিয়েছিলেন।

২০২২ সালে র‍্যাব যখন তাকে উগ্রবাদে জড়িত থাকার সন্দেহে গ্রেপ্তার করেছিল তখনও বাবা হান্নানের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়েছিল। তবে জামিনে বেরিয়ে ছেলে চাকরি শুরু করেন, বিয়েও করেন। তখন আশায় ছিলেন ছেলে সব ছেড়ে দেবেন।

তবে শেষ রক্ষা যেন তার হল না। আগের মাসেই পুরনো শঙ্কা ফিরে আসে, যখন ২০ বছর বয়সী স্ত্রী মাইশা ইসলাম হাফসাকে নিয়ে নিখোঁজ হন ২৭ বছরের এনায়েতপুরের খাজা ইউনুস আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. সোহেল তানজিম রানা।

শনিবার নবীন এ চিকিৎসকের স্ত্রীকে মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় জঙ্গি আস্তানা থেকে গ্রেপ্তারের কথা জানায় পুলিশ।

তবে কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল (সিটিটিসি) পরিচালিত ‘অপারেশন হিলসাইট’ নামে শুক্রবারের ওই অভিযানে সেই আস্তানায় ডা. সোহেল ছিলেন না। জুম্মার নামাজের জন্য তিনিসহ আরও কয়েকজন কুলাউড়ার ওই বাড়ি ঘিরে অভিযান শুরুর আগেই বেরিয়ে যান বলে এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন।

তানজীম সেখানে ‘সালমান’ নাম নিয়ে ছিলেন বলে ওই কর্মকর্তা জানান।

অভিযান শেষে আটকদের নিয়ে যাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

সাড়ে চার ঘণ্টার অভিযানে ‘ইমাম মাহমুদের কাফেলা’ নামের নতুন সংগঠনের প্রধানসহ ১০ জঙ্গিকে আটক করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ৪ জন পুরুষ, ৬ জন নারী ও ৩ শিশু রয়েছে। যাদের নিরাপদ হেফাজতে নেওয়া হয়েছে।

এ ছাড়া অভিযানে তিন কেজি বিস্ফোরক, হাই এক্সক্লোসিভ ৫০টি ডেটোনেটর, নগদ ৩ লাখ ৬১ হাজার টাকা ও জঙ্গি প্রশিক্ষণ সামগ্রী ও বিপুল পরিমাণ জিহাদী বই উদ্ধার করা হয়েছে বলেও জানান সিটিটিসির প্রধান ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান।

সকালের দিকের এ খবর হতাশার পাশাপাশি ছেলের প্রতি ক্ষুব্ধ করে তুলেছে সিরাজগঞ্জ সদরের সয়দাবাদ ইউনিয়নের আব্দুল হান্নানকে।

রেনেসাঁ টাইমস ডটকমকে তিনি ফোনে বলেন, “আমি চাষ-বাস কর‌্যাই চলি। ওরে ডাক্তার বানাইতে আমি যে কী কষ্ট করছি। আর ও হইল জঙ্গি। ও আমার যে সম্মানহানি করছে… ওরে গুলি মারলে, ফাঁসি দিলেও আমার কষ্ট হবে না।”

ডা. সোহেল ও তার স্ত্রী মাইশা গত ২৬ জুলাই থেকে নিখোঁজ ছিলেন। এ বিষয়ে সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন হান্নান। পরে তারা জানতে পারেন মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় পুলিশের জঙ্গিবিরোধী অভিযানে গ্রেপ্তার হয়েছেন মাইশা। সোহেল তানজিমও সেখানে ছিলেন, তবে তাকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। এর আগে উগ্রবাদী সন্দেহে ২০২২ সালে বাড়ি থেকে সোহেলকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল র‌্যাব।

আরও পড়ুনঃ  "মুজিব একটি জাতির রুপকার"

শনিবার সকালে এ অভিযান পরিচালনা করে ঢাকার কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের একটি দল এবং তাদের সাহায্য করে মৌলভীবাজার জেলা ও কুলাউড়া থানা পুলিশ।

শনিবার সকালে এ অভিযান পরিচালনা করে ঢাকার কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের একটি দল এবং তাদের সাহায্য করে মৌলভীবাজার জেলা ও কুলাউড়া থানা পুলিশ।
মৌলভীবাজারের জেলা পুলিশের সহায়তা নিয়ে শুক্রবার রাত থেকে ওই বাড়ি ঘিরে রেখে সেখানে অভিযান চালায় কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের কর্মকর্তারা।

এ ঘটনার পর মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে চিকিৎসক সোহেলের বাবা হান্নান বলেন, “আমার ছেলেটা ছোটবেলা থাইকাই ভালো ছাত্র ছিল। রাজশাহী মেডিকেলে যেদিন ভর্তি হইল সেদিন ভাবলাম আল্লায় মুখ তুইলা চাইছে। সবাই কয় ডাক্তারের বাপ হইছি। গত নির্বাচনের সময় ছেলেরে নিয়া নৌকা মার্কার প্রার্থী ডাক্তার মিল্লাতের ভোটও করলাম।”

তবে ছেলে এর আগে কোনো রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন না দাবি করে হান্নান বলেন, “ছেলে রাজশাহী মেডিকেলে পড়ার সময় কুনো পার্টি করতো না। না আওয়ামী লীগ, না বিএনপি-জামায়াত কোনটাতেই সে জড়িত ছিল না।”

এরপর হঠাৎ বাড়ি থেকে র‌্যাব তাকে ধরে নিয়ে গেলে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন তারা। কৃষক বাবা বলেন, “২০২২ সালের মাঝামাঝি সময়ে র‌্যাব ১ এর একটি টিম বাড়ি আইস্যা ওরে ধরে নিয়ে গেল। এক মাস ওর কোনো খুঁজ নাই, কী টেনশন আমাগের। এক মাস পর তাকে গাজীপুরের টঙ্গী পূর্ব থানার একটা মামলায় দিল র‌্যাব। সাত মাস হাজতবাসের পর হাই কোর্ট থেইক্যা ছেলের জামিন করায়া আনলাম।”

জামিনে বের হওয়ার পর ইন্টার্নি শেষ করেই সোহেল খাজা ইউনুস আলী মেডিকেলে আইসিইউ বিভাগের চিকিৎসক হিসেবে যোগ দেন বলে জানান তার বাবা।

এর মধ্যেই ছেলের মসজিদে যাওয়া আসা ও অবস্থান বেড়েছিল জানিয়ে হান্নান বলেন, “ছেলে নামাজের অনেকক্ষণ পরেও মসজিদে থাকত। আমি মাঝে মাঝে ফোন করি। একদিন জুম্মার নামাজের এক ঘণ্টা পর ফোন করলাম।

“ছেলে কয় ‘আব্বু আমি মসজিদে’। আমি বললাম, নামাজের এক ঘণ্টা হইল তুমি মসজিদে কী করো? কোনো জবাব দেয় না সে। আমি বলছি, ফের এমন করলে হাত ভাইঙা দিব। তারে বাসায় নামাজ পড়তে বলছি। কিন্তু শুনলো না।”

তিন মাস আগে পরিবারকে না জানিয়েই নাটোরে বিয়ে করেন চিকিৎসক তানজিম। তার বাবা বলেন, “তার বিয়ের ১৭ দিন পর আমি জানলাম আমার একমাত্র ছেলে আমারে না জানায় বিয়ে করছে। আমি তার সঙ্গে কথা বন্ধ কইরা দিলাম। তার মায়ে হয়তো মাঝে মাঝে কথা কইত।

আরও পড়ুনঃ  জন্ম-মৃত্যু একসঙ্গে, পাশাপাশি কবরে দাফন

“গত কোরবানির ঈদের আগে দিয়া আত্মীয়-স্বজনরা আইসা ধরল। সবাই কইল একটাই ছেলে, তাও ডাক্তার। বিয়া যখন করছে, আপনি মাইনা নেন। এরপর কোরবানির ঈদের আগে তার শ্বশুরবাড়ির লোকদের ডাইকা দাওয়াত খাওয়াইলাম। এর আগে পর্যন্ত আমি তার শ্বশুর বাড়ির কাউরে চিনতাম না। তারাও কোনদিন আমার সঙ্গে যোগাযোগ করার প্রয়োজন মনে করে নাই। ঈদের পর সে শ্বশুরবাড়ি যাবে বলে বাড়ি থেকে বাইর হইছে। সেই যাওয়াই শেষ যাওয়া। এরপর আমরা আর কোনো খোঁজ পাইনি।”

অভিযানে আটক চারজনকে আলাদা করে রাখে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

ছেলের খোঁজে দিশেহারা এই বাবা বলছেন, “গত জুলাই মাসের শেষে সে হাসপাতলের যেই ডিপার্টমেন্টে কাজ করে তার হেড আমারে ফোন দিয়া বলে ‘আপনার ছেলে তো চাইর দিন ধইরা ডিউটিতে আসে না। তার বন্ধু, কলিগরা তারে ফোন দিয়াও পাচ্ছে না। তার বউয়ের ফোনও বন্ধ।’ এরপর আমি সেখানে গেলাম। দুই-তিনদিন এখানে-ওখানে খুঁইজা এনায়েতপুর থানায় জিডি করলাম।”

চিকিৎসক সোহেলের স্ত্রীর বড় ভাই ওমর ফারুক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, কয়েক মাস আগে তার বোন হাফসার বিয়ে হয়েছিল চিকিৎসক ডা. সোহেলের সঙ্গে। গত ২৬ জুলাই হঠাৎ করে তারা পরিবার, কর্মস্থলের সঙ্গে সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে ভাড়া বাড়ি ছেড়ে চলে যান। এরপর তানজীমের বাবা থানায় একটি জিডি করেন। পরে শনিবার তারা মাইশার গ্রেপ্তারের খবর জানতে পারেন।

বাসা বদলের কথা বলে ‘গৃহত্যাগ’

বাবা হান্নানের দায়ের করা জিডির তদন্ত কর্মকর্তা এনায়েতপুর থানার এএসআই আব্দুল আলিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এক সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা গেছে, ২৬ জুলাই একটি অটোরিকশায় করে তানজিম স্ত্রীকে নিয়ে এলাকা ছাড়ছেন।

বাবা হান্নান বলেন, “ওরা যেই বাসায় ভাড়া থাকতো আমি সেইখানে গেছিলাম। তার সামনের বাসার লোকজন ওদের সেদিন যেতে দেখেছে। কাপড়-চোপড়, হাড়ি-পাতিল-চুলা, কাঁথা-বালিশ-কম্বল সব নিয়ে দুটো অটোতে করে তারা ২৬ জুলাই বাসা থেকে বের হয়। পাশের বাসার গৃহকর্ত্রী তানজীমের স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করেছিলেন তারা কোথায় যাচ্ছেন। জবাবে হাফসা বলেছিলেন, ‘তারা বাসা বদল করছেন।’ এরপর থেকে তাদের আর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি।”

তার পুত্রবধূ জঙ্গি আস্তানা থেকে আটক হয়েছিলেন এবং সেখানে তার ছেলেও ছিল এমন তথ্য জানেন কী না জানতে চাইলে আব্দুল হান্নান বলেন, “আমি তো আমার ছেলের বউয়ের নামটা জানতাম শুধু হাফসা। তারে তো আমি চিনতেও পারব না। এখন আমার ছেলে জঙ্গি হইল কি না সেটা তো আমি জানি না। একটা ছেলেকে ডাক্তার বানাইতে একজন কৃষকের কতো কষ্ট করতে হয় সেটা যদি আপনারা বুঝতেন। আমার আর কিছু বলার নাই।”

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *