বাংলাদেশশিক্ষা

ছাত্রত্ব ফিরে পেলেন সেই রফিকুল

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ

১০ বছর ৬ মাস পরে ছাত্রত্ব ফিরে পেয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রফিকুল ইসলাম। তবে মাঝের সময়টাতে বয়ে বেড়াতে হয়েছে নানা ঘাত প্রতিঘাত। থিসিস জালিয়াতির অভিযোগে ছাত্রত্ব বাতিল হয় তার। গত ৬ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটের ৫৩৬তম সভায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

ছোট থেকেই তুখোড় মেধার অধিকারী ছিলেন রফিকুল ইসলাম। স্কুল-কলেজের পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) ফলিত গণিত বিভাগে।

২০০৮ সালে প্রথম বর্ষের পরীক্ষায় ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়ে উত্তীর্ণ হন রফিক। কিন্তু এই প্রথম হওয়াটাই কাল হয়ে দাঁড়ায় রফিকের জীবনে। ভালো ফলাফল করায় শিবির সন্দেহে নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ফলিত গণিত বিভাগ থেকে তুলে নিয়ে পুলিশের হাতে সোপর্দ করেন রফিককে। ফলে ৪ মাস ৭ দিন কারাবরণ করতে হয়েছে তাকে।

জেলখানা থেকে দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষায় অংশ নিয়ে সেখানেও প্রথম হোন রফিকুল। এভাবেই নানা প্রতিকুলতা অতিক্রম করে অনার্সে ৩.৮০ পেয়ে বিভাগে প্রথমস্থান অর্জন করেন তিনি। রফিকুলের স্বপ্ন ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবেন; কিন্তু সেই স্বপ্ন পূরণ হতে দেননি বিভাগের তিন শিক্ষক। মাস্টার্সের থিসিস জালিয়াতির অভিযোগ এনে তার ছাত্রত্ব বাতিল করে দেওয়া হয়; ফলে ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রকাশ করা হয়নি রফিকুলের মাস্টার্সের ফলাফল।

কিন্তু রফিকুল থেমে ছিলেন না। ২০১৬ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগ থেকে সিজিপিএ ৪.০০ পেয়ে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। পরবর্তীতে, ২০২৪ সালে চীনের ডালিয়ান ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং মেকানিক্স বিভাগে মাস্টার্স ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। কিন্তু ভাগ্যের কি পরিহাস থিসিস জালিয়াতির অভিযোগ মাথায় নিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়তে হয়েছিল তাকে।

রফিকুল ইসলামের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অনার্সে প্রথম স্থান অর্জন করে ২০১৪ সালে বিভাগের তৎকালীন সভাপতি বর্তমান অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. শামসুল আলম সরকারের অধীনে মাস্টার্সের থিসিস নেন তিনি। এদিকে, ২০১৪ সালের ১১ আগস্ট ফলিত গণিত বিভাগে ২ জন প্রভাষক চেয়ে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। মাস্টার্সের ফলাফল প্রকাশ না হওয়ায় পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সার্টিফিকেট দেখিয়ে রফিকুলও এ নিয়োগে আবেদন করেন।

আরও পড়ুনঃ  ঠাকুরগাঁওয়ে পিঁয়াজের বীজ চাষে স্বপ্ন দেখছেন কৃষকরা

কিন্তু নিয়োগ বোর্ডে মাস্টার্সের সনদ দেখাতে হবে বলে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়। এসময় রফিকুলের থিসিস সুপারভাইজার অধ্যাপক ড. মো. শামসুল আলম সরকারের বিরুদ্ধে সিলগালা প্যাকেট খুলে নম্বরপত্র টেম্পারিংয়ের অভিযোগ এনে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের কাছে লিখিত অভিযোগ দেন বিভাগের শিক্ষক ড. আব্দুল হক। এর পরিপ্রেক্ষিতে ফলাফল প্রকাশ স্থগিত ঘোষণা করা হয়। এদিকে ২৮ জুন এমএসসি পরীক্ষা শেষ হলেও ৮ মাসেও প্রকাশ করা হয়নি ফলাফল।

বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক দফতরে এর কারণ জানতে চাইলে জানায়, বিভাগের ৮ জন শিক্ষক ফলাফল প্রকাশের পক্ষে ছিলেন কিন্তু বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. আলি আকবর ও অধ্যাপক ড. মো. আশরাফুজ্জামান খান চায়নি ফলাফল প্রকাশ হোক। ফলে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয় এবং সেখানে বলা হয় তদন্ত প্রতিবেদন না হওয়া পর্যন্ত ফলাফল ঘোষণা স্থগিত থাকবে।

২০১৫ সালের ২০ আগস্ট তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. মোহা. রেজাউল করিম থিসিস পেপার জালিয়াতি ও হাতে নকল নম্বর আনার অভিযোগে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেন রফিকুলকে। ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৬১তম সিন্ডিকেটে ১৩৭ নম্বর সিদ্ধান্তে মাস্টার্সের রেজিস্ট্রেশন বাতিলের মাধ্যমে রফিকুলের ছাত্রত্ব বাতিল করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রশাসন।

এদিকে, দেশের ক্ষমতা পরিবর্তন হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ড. সালেহ্ হাসান নকীবের কাছে রেজিস্ট্রেশন পুনর্বহাল ও ফলাফল প্রকাশের দাবি জানিয়ে গত বছরের ৩ অক্টোবর লিখিত অভিযোগ দেন রফিকুল ইসলাম।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ছাত্রত্ব বাতিল বিষয়ে একটি রিভিউ কমিটি গঠন করে।

রিভিউ কমিটির প্রতিবেদন বিবেচনা করে সিন্ডিকেটে তার ছাত্রত্ব পুনর্বহাল ও তার পরীক্ষার অপ্রকাশিত ফল প্রকাশের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। গত ৬ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটের ৫৩৬তম সভায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

ছাত্রত্ব ফিরে পাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে রফিকুল ইসলাম বলেন, শহীদ আবু সাঈদ, মুগ্ধ, আলী রায়হানদের রক্তের বিনিময়ে দেশ স্বৈরাচারমুক্ত হয়েছে। দীর্ঘ ১০ বছর ৬ মাস ধরে বয়ে বেড়ানো জুলুমের পাহাড় আজ বুক থেকে নেমে গেল, আলহামদুলিল্লাহ। এত দীর্ঘ সময় পর আমার ছাত্রত্ব ফিরে পাওয়ায় রাবি প্রশাসনের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ।

আরও পড়ুনঃ  মাদ্রাসা পড়ুয়া আবু বকর সিদ্দিকের যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হওয়ার গল্প

তিনি আরো বলেন, যদিও আমার জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া দিনগুলো কখনোই ফিরে আসবে না, তবুও প্রিয় ক্যাম্পাস থেকে মাস্টার্সের ফলাফল ফিরে পাওয়াটা আমার জন্য পরম আনন্দের। এই আনন্দের গভীরতা ভাষায় প্রকাশ করা আমার পক্ষে সত্যিই অসম্ভব। শিক্ষকদের দ্বন্দ্বে আর কোনো ছাত্রের জীবনে এমন অমানিশার অন্ধকার আর নেমে না আসুক, এই আমার প্রত্যাশা।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button