

একজন কৃষক তার ঘাম ঝরিয়ে ফসল ফলান। মাটি, বীজ, পানি আর পরিশ্রম মিলিয়ে তিনি স্বপ্ন দেখেন। কিন্তু সেই স্বপ্ন যখন এক রাতের মধ্যে দুর্বৃত্তদের হাতে ধুলিসাৎ হয়ে যায়, তখন শুধু কৃষক নন, পুরো সমাজই হারায় কিছু মূল্যবান মূল্যবোধ। লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ উপজেলার কৃষক মোশারফ হোসেন মিজির ক্ষেতের ১১০০ শসার গাছ উপড়ে ফেলেছে দুর্বৃত্তরা। এতে তার আড়াই লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। এ ঘটনা যেমন দুঃখজনক, তেমনি আমাদের সমাজের এক নির্মম চিত্রও তুলে ধরে।
কৃষকের স্বপ্ন ভাঙার গল্প
কৃষক মোশারফ হোসেন মিজি চলতি মৌসুমে ‘স্মার্ট কৃষি প্রকল্প’-এর অধীনে শসা চাষ করেছিলেন। তার ক্ষেতের ফসল ভালো আসছিল। শসাগুলো বড় হচ্ছিল, আর কয়েক দিনের মধ্যেই বাজারে বিক্রি করতে পারতেন। কিন্তু বুধবার সকালে শ্রমিকরা এসে দেখেন, সব গাছ মরে গেছে। কে বা কারা বিষ দিয়ে বা গাছ উপড়ে এই অপকর্ম করেছে, তা এখনো জানা যায়নি। তবে ক্ষতির পরিমাণ অনুমান করা কঠিন নয়—প্রায় আড়াই লাখ টাকা!
এমন ঘটনা কোনো বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়। দেশের বিভিন্ন স্থানে কৃষকদের ক্ষেত নষ্ট করার ঘটনা শোনা যায়। কখনো ব্যক্তিগত শত্রুতা, কখনো প্রতিহিংসা, কখনো ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বিতা, আবার কখনো নিছক অন্যায় করার প্রবণতায় এমন ন্যক্কারজনক কাজ হয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, একজন কৃষকের জীবিকার ওপর এমন আঘাত কেন? তার পরিশ্রমের মূল্য কেন দেওয়া হয় না?
কৃষক কি তবে অসহায়?
একজন কৃষক যখন মাঠে কাজ করেন, তখন তিনি কেবল নিজের পরিবারের জন্য নয়, পুরো দেশের মানুষের জন্য খাদ্য উৎপাদন করেন। কৃষিই আমাদের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি। অথচ কৃষকদের জীবিকা আজ নানা সংকটে। ক্ষেতের ফসল নষ্ট করে দেওয়া, দুষ্প্রাপ্য সার ও কীটনাশকের দাম বাড়ানো, বাজারে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য—এসব মিলিয়ে কৃষক এক অসহায় পেশায় পরিণত হয়েছে।
এ ঘটনার পর স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তা হাবিবুর রহমান ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন এবং সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা কি শুধুই আশ্বাস পাবেন? তাদের ক্ষতির বাস্তবিক ক্ষতিপূরণ কীভাবে দেওয়া হবে? এ ধরনের ন্যক্কারজনক কাজ যারা করেছে, তারা কি কোনো শাস্তি পাবে?
প্রশাসনের দায়িত্ব কী?
এটি নিছক একটি কৃষকের ক্ষতির ঘটনা নয়, এটি আমাদের কৃষিনির্ভর অর্থনীতির এক করুণ চিত্র। দুর্বৃত্তরা যদি এভাবে কৃষকের ক্ষতি করতেই থাকে, তাহলে ভবিষ্যতে আর কেউ কৃষি নিয়ে স্বপ্ন দেখবে না। প্রশাসনের উচিত দ্রুত তদন্ত করে অপরাধীদের খুঁজে বের করা এবং যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নেওয়া। কৃষকদের জন্য দ্রুত ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করা দরকার।
সরকার নানা সময় কৃষকদের জন্য ভর্তুকি ও সহযোগিতার কথা বললেও বাস্তবে ক্ষুদ্র কৃষকরা তেমন কোনো সুবিধা পান না। মোশারফ হোসেন মিজির ক্ষেত নষ্ট হয়ে গেছে, তার লোকসান হয়েছে। এখন যদি তিনি এই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে কোনো আর্থিক সহায়তা না পান, তাহলে তার পরবর্তী চাষাবাদ কিভাবে চলবে? তিনি কীভাবে তার পরিবারের ভরণপোষণ করবেন?
সমাজের দায়বদ্ধতা
এ ঘটনা আমাদের সবাইকে ভাবিয়ে তোলা উচিত। শুধুমাত্র প্রশাসনের ওপর দায় চাপিয়ে দিলেই হবে না, আমাদের সমাজকেও সচেতন হতে হবে। একটি এলাকায় বসবাসকারী মানুষজন যদি সতর্ক থাকেন, তাহলে হয়তো এ ধরনের অপরাধ কমে আসতে পারে। যারা কৃষকদের ক্ষতি করে, তারা সমাজেরই একদল মানুষ। তাদের চিহ্নিত করতে হলে স্থানীয় জনগণেরও দায়িত্ব রয়েছে।
কৃষকদের নিরুৎসাহিত করা মানে দেশের কৃষি উৎপাদন কমিয়ে দেওয়া। অথচ এই কৃষকরাই আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন। যারা আজ দুর্বৃত্তদের হাতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তারা যদি একসময় চাষাবাদ বন্ধ করে দেন, তাহলে আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ কী হবে?
কী করা উচিত?
প্রথমত, এই ঘটনার তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। দ্বিতীয়ত, ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক যেন দ্রুত সরকারি সহায়তা পান, তা নিশ্চিত করতে হবে। তৃতীয়ত, কৃষকদের নিরাপত্তা জোরদার করতে হবে, যেন ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে।
কৃষক আমাদের দেশের মেরুদণ্ড। তাদের প্রতি অবিচার করা মানে দেশের অর্থনীতির মূল ভিত্তির ওপর আঘাত হানা। একটি উন্নত দেশ গড়তে হলে কৃষকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতেই হবে। মোশারফ হোসেন মিজির ক্ষেত নষ্ট হওয়ার ঘটনা শুধু তার ব্যক্তিগত ক্ষতি নয়, এটি গোটা কৃষি ব্যবস্থার প্রতি এক বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। এটি আমাদের জন্য সতর্কবার্তা—আজ যদি আমরা কৃষকের পাশে না দাঁড়াই, তাহলে ভবিষ্যতে হয়তো খাদ্য সংকটের মুখে পড়তে হতে পারে।
একজন কৃষক তার শ্রম দিয়ে ফসল ফলান, কিন্তু দুর্বৃত্তরা এক রাতে সেই শ্রমের বিনাশ ঘটায়। এটি শুধু অন্যায় নয়, এটি এক ধরনের সামাজিক অপরাধ। কৃষকদের প্রতি এই অবিচার রোধ করতে হবে। প্রশাসন, স্থানীয় জনগণ, এবং আমাদের সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে, যেন আর কোনো কৃষককে এভাবে চোখের জলে দিন কাটাতে না হয়।
সরকারের উচিত কৃষকদের জন্য দ্রুত সুরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করা। স্থানীয় প্রশাসনকে আরও তৎপর হতে হবে। অন্যথায়, কৃষকরা একসময় হাল ছেড়ে দেবেন, যা আমাদের জন্য ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে। এখনই সময়, কৃষকের পাশে দাঁড়ানোর!
লেখক: মুহাম্মদ নূরে আলম, শিক্ষার্থী ও গণমাধ্যমকর্মী